রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যদি একটি বিড়াল আপনার সামনে দিয়ে চলে যায়, আপনি কি থমকে দাঁড়ান? বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু শুধু কুসংস্কারেই কি থেমে যায় গল্প? না, বিজ্ঞান বলছে অন্য কথা! সম্প্রতি প্রাণীবিদ্যা গবেষণা ও ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিড়ালের রাস্তা কাটার পেছনে লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার কৌশল এবং প্রকৃতির নিয়ম। চলুন জেনে নিই এই বিশ্বাসের উৎপত্তি থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক সত্য।
কুসংস্কার: বিশ্বজুড়ে বিড়ালকে নিয়ে ভয়-ভক্তি
- বাংলাদেশ ও ভারত:অনেকের ধারণা, বিড়াল রাস্তা কাটলে অশুভ কিছু ঘটার আশঙ্কা থাকে। অনেকে এড়িয়ে চলেন বা থুথু ফেলেন “নেগেটিভ এনার্জি” দূর করতে।
- পশ্চিমা দেশগুলো:মধ্যযুগে ইউরোপে বিড়ালকে ডাইনি বা অশুভ শক্তির প্রতীক মনে করা হতো। আজও কিছু সংস্কৃতিতে বিড়ালের পথ কাটাকে দুর্ভাগ্যের লক্ষণ বলা হয়।
- জাপান:সেখানে বিড়ালকে ভাগ্যবান প্রাণী মনে করা হয়। “মানেকি নেকো” (আশীর্বাদী বিড়াল) মূর্তি দোকান-অফিসে রাখা হয় সমৃদ্ধির জন্য!
বিজ্ঞান কী বলে?
প্রাণীবিদদের মতে, বিড়ালের এই আচরণের পেছনে মূলত ৩টি কারণ কাজ করে:
১. শিকারের কৌশল: বিড়ালরা শিকার ধরার সময় গোপনে এগোয়। রাস্তা পার হওয়ার সময় মানুষের সামনে পড়লে তারা দ্রুত লুকিয়ে যায়, যা আমাদের কাছে “রহস্যময়” মনে হয়।
২. নিজের এলাকা চিহ্নিত করা: বিড়ালরা গন্ধ ও শব্দ দিয়ে তাদের টেরিটরি (অঞ্চল) মার্ক করে। রাস্তা পার হওয়া মানে তারা নতুন এলাকা পরীক্ষা করছে।
৩. সূর্যকিরণের প্রতি আকর্ষণ: শীতকালে বিড়ালরা রোদ পোহানোর জন্য প্রায়ই রাস্তার উষ্ণ পিচ ঢালাইয়ের উপর শুয়ে থাকে। গাড়ির হর্ন শুনে দৌড় দিলে তা মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।
বিড়ালের দৃষ্টিশক্তি: রাতের যোদ্ধা
বিড়ালের চোখ মানুষের চেয়ে ৬ গুণ বেশি আলো শনাক্ত করতে পারে। তাই তারা রাতেও পরিষ্কার দেখে। রাস্তায় চলার সময় বিড়ালের পথ কাটা মানে তারা হয়তো কোনো শিকার (ইঁদুর, পোকা) লক্ষ্য করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিড়ালের হঠাৎ দৌড়ানো মানুষের অজান্তেই বিপদ (যেমন: সাপ, ভাঙা গর্ত) সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে!
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মিশরের প্রাচীন সভ্যতায় বিড়ালকে দেবী “বাস্টেট” এর প্রতীক মনে করা হতো। সেসময় বিড়াল হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত! পরবর্তীতে মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগ রোগ ছড়ানোর জন্য ইঁদুর শিকারি বিড়ালদের হত্যা করা হয়েছিল, যা ঐতিহাসিক ভুল বলে স্বীকৃত। এই দ্বন্দ্বই হয়তো বিড়ালকে নিয়ে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “বিড়ালের আচরণকে অশুভ ভাবার কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ নেই। বরং তারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি বিড়াল বছরে প্রায় ১,০০০ ইঁদুর শিকার করে, যা ফসল ও স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে।”
কী করবেন যদি বিড়াল রাস্তা কাটে?
- ভয় পাবেন না, দাঁড়িয়ে পড়ুন এবং বিড়ালটিকে নিরাপদে যেতে দিন।
- গাড়ি চালকরা স্পিড কমিয়ে দিন, যাতে বিড়াল বা অন্য প্রাণী রাস্তা পার হতে পারে।
- শিশুদের শেখান: বিড়ালকে পানি ছিটিয়ে বা পিটিয়ে তাড়ানো উচিত নয়।
উপসংহার
বিড়ালের পথ কাটাকে অশুভ মনে না করে, বরং প্রকৃতির এই ছোট্ট বন্ধুটির বেঁচে থাকার লড়াইকে সম্মান দিন। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সমন্বয়েই গড়ে উঠুক প্রাণীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। মনে রাখবেন, বিড়াল যখন রাস্তা কাটে, সে হয়তো আপনাকে বলছে— “সাবধান, সামনে ঝুঁকি আছে!”