মানুষের শেষযাত্রার প্রস্তুতিতে স্বল্পব্যয়ী বা গরিব পরিবারকে সাহায্য করতে প্রায় ৩৫ বছর ধরে বিনামূল্যে কাফনের কাপড় (মৃতদেহ জড়ানোর সাদা কাপড়) বিতরণ করে চলেছেন বাগেরহাটের পালোয়ান পরিবার। এই অসাধারণ মানবিক উদ্যোগের পেছনে রয়েছে এক ট্র্যাজেডির গল্প, যা আজ সমাজে আলোড়ন তুলেছে।
কীভাবে শুরু হলো এই যাত্রা?
১৯৯০ সালের এক বৃষ্টির রাতে পালোয়ান পরিবারের কর্তা হাজী আব্দুল জলিল দেখলেন, এক গরিব মহিলা স্বামীর মৃতদেহ কাফন ছাড়া কবর দিতে পারছেন না। সেই দৃশ্য তাঁর হৃদয়ে গভীর দাগ কাটে। পরদিনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—যেকোনো মূল্যে গরিবদের বিনামূল্যে কাফন দেওয়া হবে। তাঁর মৃত্যুর পর এই মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন ছেলে মো. সোহেল পালোয়ান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
কীভাবে চলে এই উদ্যোগ?
- অর্থের উৎস:পারিবারিক জমির আয়, স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি ও ছোট ব্যবসায়ীদের সহায়তা।
- কাপড় সংগ্রহ:প্রতি মাসে ৩০০ মিটার সাদা সুতি কাপড় কেনা হয়।
- বিতরণ পদ্ধতি:স্থানীয় মসজিদ, কবরস্থান ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনের খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া হয়।
কী বলছেন পরিবারের সদস্যরা?
মো. সোহেল পালোয়ান বলেন, “বাবা বলতেন, ‘মৃত্যুর পর মানুষের সম্মানটুকু দেওয়াও ইবাদত।’ আমরা তাঁর স্বপ্নকে ধারণ করেছি। গত বছর ১,২০০টি পরিবারকে কাফন দিয়েছি।”
পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য সায়মা আক্তার যোগ করেন, “পরীক্ষার সময়ও কেউ ফোন দিলে ছুটে যাই। এটা আমাদের পরিবারের নীতি।”
যাদের সাহায্য পেয়েছেন তাদের কথা
বাগেরহাটের রিকশাচালক মো. করিমের স্ত্রী মারা গেলে তিনি পালোয়ান পরিবারের কাছে সাহায্য চান। তিনি বলেন, “ওরা শুধু কাপড় দেয়নি, কবর দেওয়ার খরচও যোগাড় করে দিয়েছিল।”
স্থানীয় ইমাম মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, “এই উদ্যোগ আমাদের সমাজে সম্প্রীতির বার্তা ছড়াচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এখানে সাহায্য পায়।”
শিশুদের জন্য সহজ ব্যাখ্যা
কাফনের কাপড় হলো খুব সরল সাদা কাপড়, যা দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে সম্মানের সাথে কবরে শোয়ানো হয়। অনেক গরিব মানুষ এই কাপড় কিনতে পারে না। পালোয়ান পরিবার তাদের সেই কষ্ট কমাচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
- ডিজিটাল সেবা:একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হবে, যাতে মানুষ ফোন করে সাহায্য চাইতে পারে।
- অন্য জেলায় সম্প্রসারণ:খুলনা ও সাতক্ষীরায় নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনা।
সমাজের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বলেন, “এই উদ্যোগ সরকারি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। আমরা তাদের জন্য বিশেষ সম্মাননা ঘোষণা করব।”
শেষ কথা:
পালোয়ান পরিবারের এই মানবিক উদ্যোগ প্রমাণ করে, ছোট্ট একটি প্রচেষ্টাই সমাজে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তাদের কাজ শেখায়—মৃত্যুই শেষ নয়, মৃত্যুর পরেও মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।